আল্লাহ কে রাজি করাতে মানত, যা বলে ইসলাম
মানত, খুবই পরিচিত একটি শব্দ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। কোনও কিছু প্রাপ্তির জন্য, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মহান আল্লাহকে রাজি করানোর উদ্দেশে হরহামেশাই ছোট-বড় বিভিন্ন কিছু মানত করে থাকি আমরা। বিশেষ করে কোনও মূল্যবান কিছু হারিয়ে গেলে তা ফিরে পেতে কিংবা আরাধ্য কোনও কিছু প্রাপ্তির আশায় তার বিনিময়ে দান-সাদকাসহ বিভিন্ন ধরনের মানত করে থাকি আমরা। কিন্তু, কোনও কিছু প্রাপ্তির বিনিময় শর্তে মানত কি জায়েজ? মানতে সত্যিই কি আরাধ্য বস্তু ধরা দেয় জীবনে; পরিবর্তন হয় ভাগ্যের? এ নিয়ে ইসলামই বা কী বলে?
মানত হলো নিজের ওপর কোনও ভালো কাজ আবশ্যক করে নেওয়া। ইসলামপূর্ব আরব সমাজে মানতের প্রচলন ছিল; এখনও এই প্রচলন কমেনি খুব একটা। পৃথিবীর প্রায় সব প্রাচীন ধর্মেই মানতের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ইসলামিক শরিয়তেও মানতকে নাজায়েজ বা অবৈধ বলা হয়নি। তবে, প্রাপ্তির শর্তে মানত করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে; অনেকটা ভিক্ষাবৃত্তির মতো।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মানত করতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা মানুষের কোনও কল্যাণ করতে পারে না। এর মাধ্যমে কেবল কৃপণ ব্যক্তির কাছ থেকে সম্পদ বের হয়। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৮০১)
তিরমিজি শরিফের ১৫৮৩ নং হাদিসেও এসেছে একই কথা। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা মানত করো না। কারণ, মানত ভাগ্য পরিবর্তন করতে অক্ষম। এর দ্বারা কৃপণ লোকের কিছু আর্থিক খরচ হয় মাত্র।’
পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মে মানতের প্রচলন ছিল। পবিত্র কোরআনেও মানতের দৃষ্টান্ত আছে। যেমন—ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত আপনার জন্য আমি উৎসর্গ করলাম। সুতরাং আপনি আমার থেকে তা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩৫)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখো, তখন বল, আমি দয়াময়ের উদ্দেশে মৌনতা অবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না। ’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ২৬)
শরিয়তের পরিভাষায় মানত বলতে বোঝানো হয়, ‘কোনো মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য) ব্যক্তির নিজের ওপর এমন কোনও কাজ আবশ্যক করা, যা শরিয়ত প্রণেতা আবশ্যক করেননি। ’ (আল-ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবায়া : ২/৭৭৯)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শরিয়ত মোতাবেক মানত করা বৈধ। তবে, তার দ্বারা আদতে ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হয় না। এছাড়া, কোনও ভালো কাজের মানত করে থাকলে তা আবশ্যক হয়ে পড়ে মানতকারীর ওপর। এক্ষেত্রেও আছে কিছু বিধিবিধান।
মানতের শর্ত
কোনো ব্যক্তির ওপর মানত আবশ্যক হওয়ার শর্ত হলো সাবালক হওয়া, জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া এবং এখতিয়ার বা ইচ্ছাধিকার থাকা। (আল-ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবায়া : ২/৭৭৯)
মানত শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলামি আইনজ্ঞরা আরো কিছু শর্তারোপ করেন। যেমন—নেক কাজের মানত করা, বান্দার সাধ্যের ভেতর হওয়া, নিজের মালিকানাধীন হওয়া, তা পাপের কারণ বা উপলক্ষ্য না হওয়া ইত্যাদি।
মানতের বিধান
মানত করলে তা পূরণ করা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন ঘরের। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৯)
অন্য আয়াতে মুমিনের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে, যেদিনের বিপত্তি হবে ব্যাপক।’ (সুরা : দাহর, আয়াত : ৭)
মৃত ব্যক্তির মানত
কোনো ব্যক্তি মানত করার পর যদি তা পূরণ করার আগেই মারা যায়, তবে তার আত্মীয়-স্বজনের দায়িত্ব হলো তা পূরণ করা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (সা.)-এর কাছে এক লোক এসে বলল যে, আমার বোন হজের মানত করেছিল, কিন্তু সে মারা গেছে। তখন নবী (সা.) বললেন, তার ওপর কোনো ঋণ থাকলে তবে কি তুমি তা আদায় করতে না? লোকটি বলল, হ্যাঁ। নবীজি (সা.) এরপর বললেন, কাজেই আল্লাহর হককে আদায় করে দাও। কেননা আল্লাহর হক আদায় করা আরও বড় কর্তব্য। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৬৯৯)
তবে, কোনও কোনো ব্যক্তি অন্যায় মানত করলে তা পূরণ করা মানতকারী বা তার উত্তরসূরি কারও জন্যই আবশ্যক নয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের মানত করে সে যেন তাঁর আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার মানত করে, সে যেন তাঁর অবাধ্য না হয়। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩২৮৯)
বহুদিন আগের মানত
মানত করার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলে গেলেও তা পূরণ করা আবশ্যক। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি জাহেলি যুগে মসজিদুল হারামের ভেতর এক রাত ইতেকাফ করার মানত করেছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার মানত পূরণ কোরো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০৩২)
শরিয়তের সীমার মধ্যে থাকা
মানত পূরণের জন্য ব্যক্তি কখনও শরিয়তের সীমা অতিক্রম করতে পারবে না। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি সোমবার রোজা রাখার মানত করে এবং সেদিন ঈদ হয়, তবে সে সর্বসম্মতিক্রমে রোজা রাখবে না। ’ (শরহুন নববী : ৮/১৬)
নিজের ওপর কষ্ট চাপিয়ে মানত নয়
মানতের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ওপর কোনও কষ্ট চাপিয়ে নেবে না। কেননা নিজেকে কষ্ট দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার দুই ছেলের ওপর ভর করে হেঁটে যেতে দেখে বললেন, তার কী হয়েছে? তারা বলল, তিনি পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন বললেন, লোকটি নিজেকে কষ্ট দিক, আল্লাহ তা’আলার এর কোনও দরকার নেই। অতঃপর তিনি তাকে সওয়ার হয়ে চলার জন্য আদেশ করলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬৫)
বিকল্প জিনিস দ্বারা মানত পূরণ
যদি কোনও ব্যক্তি এমন কোনও বিষয়ের ওপর মানত করে, যা সেই ব্যক্তির জন্য কষ্টসাধ্য, তবে বিকল্প জিনিস দ্বারা মানত পূরণ করা বৈধ। বিশেষত বিকল্প যখন মূলের চেয়ে উত্তম হয়। যেমন— জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মক্কা বিজয়ের দিন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর জন্য মানত করেছি যে, আল্লাহ যদি আপনাকে মক্কায় বিজয়ী করেন, তবে বায়তুল মুকাদ্দাসে দুই রাকাত নামাজ আদায় করব। নবী (সা.) বলেন, তুমি এখানেই নামাজ আদায় করো। লোকটি তার কথার পুনরাবৃত্তি করল। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি এখানে নামাজ আদায় করো। লোকটি আবারও তার কথার পুনরাবৃত্তি করল। নবী (সা.) তখন বললেন, এই ব্যাপারে তোমার স্বাধীনতা আছে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৩০৫)
মানতের কাফফারা
মানত পূরণ না করলে ব্যক্তি কাফফারা দেবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানতের কাফফারা কসমের কাফফারার মতো। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৮৩৪)
কসমের কাফফারা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর এর কাফফারা ১০ জন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাবার দান করা—যা তোমরা তোমাদের পরিবারকে খেতে দাও, অথবা তাদেরকে কাপড় দান করা কিংবা একজন দাসকে মুক্ত করা। যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন রোজা পালন করা। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮৯)
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন। আল্লাহ