হুমায়ুন ফরীদি মৃত্যুকে কেন ভালোবাসতে বলেছিলেন
হুমায়ুন ফরীদির মতো দারুণ সাহিত্যজ্ঞান নিয়ে মঞ্চ, ছোট পর্দা, বড় পর্দায় সমানতালে দাপট দেখানোর মতো অভিনেতা বাংলাদেশে হাতে গোনা।
এমন বিরল প্রতিভা নিয়ে অভিনয়ের সব মাধ্যমে দাপট দেখিয়েছেন তিনি। এ কথা অনেকেই বলেন, অভিনেতা হিসেবে তিনি যেমন শক্তিমান, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অনন্য। আজ এই শক্তিমান অভিনেতার চলে যাওয়ার এক যুগ। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ছড়িয়ে পড়ে, তিনি ঢাকার ধানমন্ডির বাসায় শেষবারের মতো নিশ্বাস ছেড়েছেন পৃথিবীর বাতাসে। মৃত্যু মানে তো আর মানুষের অস্তিত্বের বিলীন হয়ে যাওয়া নয়। মানুষ তাঁর সৃষ্টি ও কর্ম দিয়ে অস্তিত্বকে যুগ যুগ ধরে কালোত্তীর্ণ করে রাখেন। মৃত্যুকে জয় করার উপায় না থাকলেও যেকোনো মানুষ তাঁর কর্ম দিয়ে এভাবেই মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠেন। হুমায়ুন ফরীদি তেমনই একজন, যিনি তাঁর দাপুটে অভিনয় দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী।
মৃত্যুর এই দিনে মৃত্যু নিয়ে তাঁর কিছু কথা মনে পড়ছে। তাঁর বলা এসব কথা নানা সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার ভিডিও ক্লিপ এবং রিলস আকারেও সামনে আসে। মৃত্যু নিয়ে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতো এত স্নিগ্ধ, এত গভীর সুন্দর আর কিছু নেই। কারণ, মৃত্যু অনিবার্য। তুমি যখন জন্মেছ, তখন মরতেই হবে। মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় থাকলে কেউ পাপ করবে না। যেটা অনিবার্য, তাকে ভালোবাসাটাই শ্রেয়।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মৃত্যুকে ভয় পাওয়া মূর্খতা। জ্ঞানীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করো, গ্রহণ করো, বরণ করে নাও। তাহলে দেখবে জীবন কত সুন্দর।’
হুমায়ুন ফরীদির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৭০ সালে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন বিভাগে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থগিত হয়ে যায় তাঁর পড়াশোনা। স্বাধীনতার পর অর্থনীতি বিষয়ে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধার স্বাক্ষর রাখেন প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফলে।
নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা মঞ্চ—সবখানেই ছিল হুমায়ুন ফরীদির অবাধ বিচরণ। মঞ্চ দিয়েই শুরু তাঁর পথচলা। প্রথম মঞ্চনাটক কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটকে ১৯৬৪ সালে। প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দেন স্কুলজীবনে—‘ভূত’। ১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নাট্যোৎসব আয়োজনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলোতেই ফরীদি সম্পৃক্ত হন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সদস্য হিসেবেও অভিনয়ের আলো ছড়িয়ে বেড়ান সারা দেশে। যদিও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তনাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এখানে তিনি ‘আত্মস্থ ও হিরণ্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লেখেন, নির্দেশনা দেন এবং অভিনয় করেন। বিচারকদের কাছে তখন এই নাটক পাঁচটি সেরা নির্বাচিত হয়। এ নাটকের সুবাদে পরিচয় ঘটে ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে। মূলত এখান থেকেই হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়যাত্রা। ঢাকা থিয়েটারের মধ্য দিয়ে হুমায়ুন ফরীদির মঞ্চযাত্রা শুরু হয়।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘চা আনা আর কস্টিউম পরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত আমার গণ্ডি। আর সেলিম আল দীনের “চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি” নাটকের প্রোডাকশনে কাজ করি। এরপর একই দলের একই লেখক ও নির্দেশকের “সংবাদ কার্টুন”-এ ছোট্ট একটি চরিত্রে সুযোগ পাই। তারপর “শকুন্তলা”।’ তাঁকে স্মরণ করে এক স্মৃতিচারণায় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, ‘হুমায়ুন ফরীদি যখন প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করল, তখনই আমি সবাইকে বলেছিলাম, এই ছেলে মঞ্চ কাঁপাবে। অবশ্য ফরীদি কিন্তু মঞ্চের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চলচ্চিত্রে। তার রসবোধ ছিল প্রখর। কোনো একটা সিরিয়াস মুহূর্তকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিতে তার তুলনা ছিল না।’
মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন ফরীদি। শকুন্তলার পর ‘ফণীমনসা’, ‘কীর্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ এবং ১৯৯০ সালে ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় হুমায়ুন ফরীদির ঢাকা থিয়েটার জীবন। মূলত বন্ধু-অভিনেতা আফজাল হোসেনের সাহস ও উৎসাহে হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশন–যাত্রা শুরু হয়। আফজাল হোসেন বন্ধুর কথা ভেবে অনেকগুলো নাটক লেখেন। ১৯৮০ সালে ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এর মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকে অভিষেক হয় হুমায়ুন ফরীদির। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দেন।
যদিও টেলিভিশনে অভিষেকটা ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর মাধ্যমে। সেটাও অবশ্য আফজাল হোসেন ও রাইসুল ইসলাম আসাদের সুবাদে। সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর নির্দেশনায় ধারাবাহিক নাটক ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ দিয়ে আলোচনায় আসেন ফরীদি। এখানে তাঁর চরিত্রের নাম ছিল সেরাজ তালুকদার। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত বিখ্যাত ‘সংশপ্তক’ নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছিলেন তিনি।
ফরীদি অভিনীত অন্যান্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চান মিয়ার নেগেটিভ পজিটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, ‘তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘ভবের হাট’ ও ‘শৃঙ্খল’। তাঁর অন্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘প্রিয়জন নিবাস’। সর্বশেষ তিনি ‘তখন হেমন্ত’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটক পরিচালনা করেন এবং ‘পূর্ণ চাঁদের অপূর্ণতায়’ নামের একটি নাটকে অভিনয় করেন।
বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেওয়া অভিনয়শিল্পী ফরীদির নাটক থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার ব্যাপারটি ছিল অনেক বেশি সিনেম্যাটিক। দেশের চলচ্চিত্রের করুণ দশা দেখে বড় পর্দায় কাজ করবেন কি না, এ বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কাছের মানুষদের প্রেরণায়, নিজের দৃঢ়তায় বড় পর্দায় আসেন ফরীদি। তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি। নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’, ‘দিনমজুর’, ‘বীরপুরুষ’ ও ‘লড়াকু’ ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপরই দেশীয় চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্র পায় এক অনন্য মাত্রা। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে একসময় মানুষ নায়কের পরিবর্তে তাঁকে দেখার জন্যই প্রেক্ষাগৃহে যেত। শহীদুল ইসলাম খোকন ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘অপহরণ’, ‘দুঃসাহস’সহ ২৮টি ছবির মধ্যে ২৫টিতে অভিনয় করেন ফরীদি। তাঁর অভিনীত ছবির তালিকায় আরও আছে ‘দহন’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘দূরত্ব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘অধিকার চাই’, ‘ত্যাগ’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘মাতৃত্ব’ ও ‘আহা!’। ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফরীদি। ২০১৮ সালে পেয়েছেন মরণোত্তর একুশে পদক।