বাণিজ্যবাংলাদেশ

নিজেদের ব্যাংকেই ডাকাতি করেন যাঁরা

নিজেদের ব্যাংকেই ডাকাতি করেন যাঁরা

১৯৮০–এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এত বেশি ব্যাংক ডাকাতি হতো যে একবার মার্কিন টেলিভিশন উপস্থাপক ও কৌতুক অভিনেতা জনি কারসন এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যেকোনো সময় কোনোরকম কথাবার্তা ছাড়াই কোনো ট্যাক্সিক্যাবে যদি চারজনকে একসঙ্গে উঠতে দেখেন, তাহলে ধরে নেবেন ব্যাংক ডাকাতি হতে যাচ্ছে।

মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই নিয়মিতভাবে ব্যাংক ডাকাতির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৬১২টি ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে। ২০০৯ সালে ছিল ৫ হাজার ৯৪৩টি। সুতরাং ব্যাংক ডাকাতি যে কমে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ব্যাংক ডাকাতির আরও অনেক রকম পদ্ধতি বের হয়ে গেছে।

গবেষকেরাও বলেন, ঝুঁকির তুলনায় ব্যাংক ডাকাতি থেকে লাভ এখন অনেক কম। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক ডাকাতি হয় কোস্টারিকায়। এর পরেই আছে আর্জেন্টিনা ও চিলি।

বাংলাদেশে ব্যাংক ডাকাতির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে সম্ভবত প্রথম ব্যাংক ডাকাতি হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৩ মে। এর আগে কোনো পত্রিকায় ডাকাতির খবর প্রকাশিত হয়নি।

পরদিনের বাংলার বাণী পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছয়জনের একটি ডাকাত দল গতকাল বুধবার সকাল ১১–১৫ মিনিটে কারওয়ান বাজার শাখা পূবালী ব্যাংক (পূর্বতন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক) হতে ৩৪,৮৮৩. ৪৬ টাকা লুট করেছে। ডাকাত দল একটি সাদা রঙের ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আগমন করে। তাদের সবাই পশ্চিমা বেশভূষায় সুসজ্জিত ছিল। তাদের দুজনের মাথায় মুক্তিবাহিনী ধরণীয় টুপি এবং অন্যদের মাথায় লম্বা চুল ছিল। তাদের বয়স সতেরো থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে হবে। স্টেনগান ও রিভলবারের সম্মুখে তারা ব্যাংকের কর্মচারীদের প্রাইজবন্ডসহ সব টাকা দিতে বাধ্য করে। ব্যাংকে ঢুকে দশ মিনিটের মধ্যে তারা টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।’

১৯৭৪ সালের ৭ জুলাই জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলী জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর থেকে তখন পর্যন্ত ব্যাংক লুট হয়েছে হয়েছে ৭৯টি। আর এতে খোয়া গেছে ৬৬ লাখ ৪১ হাজার ২১৭ টাকা ২৪ পয়সা। সবচেয়ে বেশি লুট হয়েছে জনতা ব্যাংক থেকে।

চলতি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সনাতন পদ্ধতির সেই ডাকাতি আবার দেখা গেল বান্দরবানে, লুট হয়েছে দুই ব্যাংকের তিন শাখায়।

এরপরেই ব্যাংক ডাকাতি পরিসংখ্যান ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করেও লেখার ধরন পাল্টাতে হলো সাবেক এক সহকর্মীর একটি মোবাইল বার্তা পেয়ে। তিনি লিখলেন, ‘অনেক বছর পর দুটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটল, যেখানে ব্যাংকমালিক ও পরিচালকেরা জড়িত নয়’।

কথাটা কিন্তু সত্য। এখনো অতি দুঃসাহসী কেউ কেউ যে ব্যাংক ডাকাতি করেন না, তা নয়, তবে বাংলাদেশে ব্যাংক ডাকাতির মূল ধরন পাল্টে গেছে বেশ আগেই। ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে জার্মান নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখটের থ্রি পেনি অপেরা নাটকের একটা বিখ্যাত সংলাপ আছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘ব্যাংক ডাকাতি আসলে অপেশাদারদের কাজ, সত্যিকার পেশাদাররা বরং ব্যাংক তৈরি করেন।’ কিন্তু ব্রেখট-এর ধারণা ছিল না যে পেশাদার ডাকাতেরা নিজেরা ব্যাংক তৈরি করে সেখানেও ডাকাতি করেন।

ব্যাংক তৈরি করে সেখানেই ডাকাতি করার অনেক উদাহরণ বাংলাদেশেই আছে। আর তা করেন সবার চোখের সামনেই। পত্রিকার পাতা বা টেলিভিশন খুললেই তাঁদের দেখা যায়। এসব ডাকাত থাকেন ভিন্ন ভিন্ন চেহারায়। দু-একজনকে অবশ্য নানা কারণে লুকিয়েও থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি নানা সংস্থার লোকজনকে কিছুটা অভিনয় করে যেতে হয়। যেমন একটি সংস্থা মামলা করে, আরেকটি সংস্থা পরোয়ানা জারি করে, আরেকটি সংস্থা মিছিমিছি খোঁজার ভান করে।

 

ব্রেখট-এর থ্রি পেনি অপেরা নাটক এ রকম এক ব্যাংক ডাকাতি আর পুলিশের চোর–পুলিশ খেলা নিয়েই। নাটকের শেষের দিকে একটা বড় প্রশ্ন ছিল, কে বেশি অপরাধী—যে ব্যাংক ডাকাতি করে, নাকি যে ডাকাতকে খুঁজতে থাকে? নাটকটিতে শেষ পর্যন্ত অবশ্য রানি ডাকাতদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশেও এ রকম ডাকাতেরা শেষ পর্যন্ত নানাভাবে মাফই পেয়ে আসছেন।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। ‘ব্যাংক ডাকাত’ হিসেবে তাঁর নামটি ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে। এ প্রসঙ্গে আসার আগে রবার্ট অ্যালেন লিচফিল্ডের গল্পটা বলে নিই।

সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্যে থেকেও দু–দুবার যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামার জেল থেকে পালিয়েছিলেন তিনি। দুবারই একই পদ্ধতিতে পালান। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে ফ্লোরিডায় ১৫টি ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁর ৬০ বছর জেল হয়েছিল। প্রথমবার পালিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, পরেরবার ১৯৮৯ সালের মার্চে। এই তিন বছরে জর্জিয়া, ফ্লোরিডা ও মিশিগানে আবারও ব্যাংক ডাকাতি করেছিলেন রবার্ট লিচফিল্ড।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথমবার এক চিকিৎসকের পোশাক পরে জেল গেট দিয়ে সোজা বের হয়ে ট্যাক্সি ধরে চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার পালান ৪০ বছর বয়সে। এবারও পোশাক পাল্টে বের হয়ে যান। বাইরে দাঁড়ানো ছিল একটি ট্যাক্সিক্যাব। ট্যাক্সিতে উঠে সোজা চলে যান স্থানীয় একটি ব্যাংকে। সেখান থেকে একটি প্যাকেট নিয়ে আবার ক্যাবে ওঠেন। ট্যাক্সিচালককে বলেন যে তিনি ওয়াশিংটনের একজন নিরাপত্তা পরিদর্শক। দ্রুত এই প্যাকেটটি কানসাস সিটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একজনের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এরপর চালক প্যাকেটটি নিয়ে একাই চলে যান এয়ারপোর্টে, কিন্তু সেখানে তিনি কাউকেই পাননি।

পরে তদন্তে দেখা গেছে, আসলে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এমনটি করেছিলেন রবার্ট লিচফিল্ড। যাতে পুলিশ মনে করে, এয়ারপোর্ট ধরে পালাচ্ছেন তিনি। এরপর রবার্ট তাঁর ছদ্মবেশ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে কাছের একটি রেস্তোরাঁয় যান। সেখানে একজন তাঁকে ৫ হাজার ডলার দেন। সেই ডলার নিয়ে আরেকটি ট্যাক্সিতে করে কাছের একটা শপিং সেন্টারে যান। তারপর আর তাঁর গতিবিধি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

রবার্ট লিচফিল্ড বিখ্যাত হয়ে আছেন আরও একটা কারণে। তাঁর প্রিয় অভিনেতা ছিলেন রবার্ট ডি নিরো। প্রথমবার পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা বদলে ফেলেছিলেন। প্লাস্টিক সার্জন জন আফ্লেকের কাছে গিয়ে বলেছিলেন তাঁর বয়স বেড়ে যাচ্ছে, সার্জারির উদ্দেশ্য হচ্ছে বয়স কম দেখানো। তারপর তাঁর চেহারা পাল্টানো হয়। চেহারা যতটা সম্ভব করা হয় রবার্ট ডি নিরোর আদলে। পরে অবশ্য ধরা পড়েছিলেন সেই চেহারাতেই।

ধরা পড়ার পরে হাতকড়া লাগিয়ে তাঁকে যখন পুলিশের গাড়ির পেছনের আসনে বসানো হয়, তখনো পুলিশকে বলেছিলেন, ‘আমি আবার পালানোর পরিকল্পনা করছি।’ এ দফায় অবশ্য পরিকল্পনা সফল হয়নি, জেলে থাকতেই ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি ৬২ বছর বয়সে মারা যান।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মূল হোতা শেখ আবদুল হাই ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে সেই অর্থের উপযুক্ত সদ্ব্যবহারের পরে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে প্রায় এক দশক পর। সরকারি নথিতে তিনি অবশ্য পলাতক। যদিও তাঁর জমি, বাড়ি বা জাহাজ কেনার সব তথ্য সবার কাছে আছে। কীভাবে তাঁর ব্যাংক হিসাবে অর্থ ঢুকেছে, তা–ও সব পক্ষের জানা। এমনও নয় যে রবার্ট লিচফিল্ডের মতো প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পাল্টে ফেলেছেন। তারপরও তাঁকে ধরা যাচ্ছে না। আসলে তাঁকে ধরাই হবে না। তাঁর খুঁটির জোর এতটাই।

সেই শেখ আবদুল হাইয়ের পাপের বোঝা এখন চাপছে দি সিটি ব্যাংকের কাঁধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে এখন বেসিক ব্যাংকের দায়দেনার হিসাব হবে। একীভূত হবে দুই ব্যাংক। কিন্তু একসময়ের সরকারি খাতের সবচেয়ে ভালো ব্যাংকের এই পরিণতির জন্য যাঁরা দায়ী তাঁরা বহাল তবিয়তেই থাকবেন। তাঁর নিয়োগকর্তা, তাঁর রক্ষাকর্তা, তাঁকে খুঁজে না পাওয়া কর্তা—সবাই।

ব্রেখট-এর থ্রি পেনি অপেরা নাটক এ রকম এক ব্যাংক ডাকাতি আর পুলিশের চোর–পুলিশ খেলা নিয়েই। নাটকের শেষের দিকে একটা বড় প্রশ্ন ছিল, কে বেশি অপরাধী—যে ব্যাংক ডাকাতি করে, নাকি যে ডাকাতকে খুঁজতে থাকে? নাটকটিতে শেষ পর্যন্ত অবশ্য রানি ডাকাতদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশেও এ রকম ডাকাতেরা শেষ পর্যন্ত নানাভাবে মাফই পেয়ে আসছেন।

Show More
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো। বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button